প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ বিস্ময়কর বস্তুর তালিকা তৈরি করে চলেছে। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, আর্টেমিসের মন্দির, অলিম্পিয়ার গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তি, আলেক্সান্দ্রিয়ার বাতিঘর, গ্রেট পিরামিড ইত্যাদি। এই ঐতিহাসিক সপ্তাশ্চর্যগুলোর কথা আমরা সবাই জানি।
প্রথম তালিকাটি প্রকাশ পেয়েছিল বহু বছর আগে। প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একমাত্র গিজা গ্রেট পিরামিড (সম্মানসূচক স্থিতি, গিজা নেকোপোলিস, মিশর) কেউ সম্মানিক স্থান দেওয়া হয়েছে। এরপর ২০০৭ সালে সেভেন ওয়ান্ডার্স (seven wonders) এর নতুন একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় (New Seven Wonders of the World)।
এর মধ্যে পড়েছে চীনের মহাপ্রাচীর, পেত্রা (Petra) জর্ডান, দ্য রোমান কলোসিয়াম (The Roman Colosseum) রোম, চাচেন ইত্জা (Chichen Itza) য়ুকাতান উপদ্বীপ মেক্সিকো, মাচু পিচু পেরু, তাজমহল আগ্রা ভারত এবং ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার মূর্তি (Christ the Redeemer Statue) রিও ডি জেনেইরো ব্রাজিল।
এছাড়াও অন্যান্য ১৩টি চূড়ান্ত প্রতিযোগী বিস্ময়কর বস্তুর তালিকা যেমন এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস গ্রিস, আলহাম্বরা প্যালেস গ্রানাডা স্পেন, Angkor Wat কাম্বোডিয়া, আইফেল টাওয়ার প্যারিস, হাগিয়া সোফিয়া ইস্তাম্বুল তুরস্ক, কিওমিজু-দেরা কিয়োটো জাপান, মোয়াই ইস্টার আইল্যান্ড চিলি, নিউসভেনস্টাইন ফুসেন জার্মানি, রেড স্কয়ার মস্কো রাশিয়া, স্ট্যাচু অব লিবার্টি নিউ ইয়র্ক সিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্টোনহেঞ্জ অ্যামসবারি যুক্তরাজ্য, সিডনি অপেরা হাউস অস্ট্রেলিয়া এবং তিব্বতুতু টিম্বুচুতু মালি উল্লেখযোগ্য। তাজমহল বিখ্যাত পারসিক ও মুঘল স্থাপত্যকলার একটি অনিন্দ্য সুন্দর নিদর্শন।
ছোটবেলায় তাজমহলের সৌন্দর্য্যের কথা শুনে কল্পনায় তাকে চিত্রায়িত করেছি। যৌবনে প্রেমিকার চোখে দেখতে পেয়েছি তাজমহল সদৃশ সৌন্দর্য্য। আজ তাজমহলকে বাস্তবে দেখি। তাজমহলের স্রষ্টা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান-পুরুষ সম্রাট শাহজাহান। সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় স্ত্রী ছিলেন আর্জুমান্দ বানু বেগম। সম্রাট তার এই প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে। ১৬৩১ সালে মমতাজ মারা যান।
তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল ১৯ বছর। সম্রাট প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন ও প্রচণ্ড শোকাহত হন। এই শোককে প্রেমের জগতে অমর ও স্মরণীয় করতে কল্পনায় চিত্রায়িত করেন তাজমহল। আজ থেকে ৭০ বছর আগে ন্যাটো জোট গঠন করা হয়। যে দেশগুলো এই ন্যাটো জোট গঠনে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং নেত্রীত্ব দিয়েছিল তার মধ্যে আমেরিকার নাম তালিকার প্রথমে রাখলে ভুল হবে না। অন্যদিকে গঠন করা হয় ওয়ারশ চুক্তি।
উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটো (North Atlantic Treaty Organisation বা NATO)। ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিলে। ন্যাটো একটি সামরিক সহযোগিতার জোট এবং এই জোটের দেশগুলো পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতায় অঙ্গীকারবদ্ধ।
আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাড়ে অবস্থিত উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এই জোটের সদস্য। ন্যাটোর সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর খরচ পৃথিবীর সব দেশের সামরিক খরচের প্রায় ৭০ ভাগ। অন্যদিকে ওয়ারশ চুক্তি বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তার চুক্তি হিসেবে পরিচিত।
এই ওয়ারশো চুক্তি বা ওয়ারশপ্যাক ন্যাটোর গঠনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণরূপে এবং ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে গঠন করা হয়। এই জোটে যুক্ত করা হয় স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের আটটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জোট দুটি গঠন করা হয়। ওয়েস্ট ইউরোপের বেশির ভাগ দেশগুলো বেশ দুঃশ্চিতার মাঝে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ে। না জানি কখন কোথায় আক্রমণ করে! এমন একটি সময় আমেরিকা সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে কৃপণতা করেনি।
যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দল বেঁধেছিল তারা একবারও কি ভাবেনি আমেরিকা আটলান্টিক মহাসাগরের অন্য পারে, কেন তারা আমাদের বন্ধু হতে চায়? কারণ ছিল একটাই তা হলো সুপার পাওয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরো ইউরোপ এবং এশিয়া ডোমিনেট করবে তা আমেরিকা কখনও মেনে নিতে পারেনি। তাইতো উঠেপড়ে লেগেছে সব সময় পৃথিবীতে শান্তির চেয়ে অশান্তি ডেকে আনতে।
আমাদের এশিয়া মহাদেশে পাকিস্তানকে অনেকবার কাজে লাগিয়ে নানা কুকর্মের ব্যবস্থা করেছে আমেরিকা। যাই হোক না কেনো পশ্চিমা ইউরোপ ও আমেরিকা শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙেচুরে তছনছ করেছে। প্রথমে মিখাইল গর্ভাচভ, পরে বরিস নিকোলায়েভিচ য়েলৎসিন এবং শেষে পুতিন। সব চলে গেলেও রাশিয়া রয়েছে এখনও।
যারা সোভিয়েত ছেড়েছে তারা যোগ দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে। আবার অনেকে যোগ দিয়েছে শেনজেন দেশগুলোর সঙ্গে। ন্যাটো জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত বা বর্তমান রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করা। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে বেশ ভালো ভাব হয়েছিল, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম এবং পুতিনের মধ্যে, বলতে গেলে তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এক্ষেত্রে কি মনে হয়? ন্যাটো সদ্যদের বুঝতে কিছুটা দেরি হলেও তারা এখন সচেতন।
সচেতন জাতি খোঁজে সমাধান। তাই গতবারের ন্যাটো জোট সেলিব্রেশন তেমন আনন্দময় মুহূর্ত দিতে পারেনি ট্রাম্পকে। ন্যাটো মেম্বাররা তাকে মাথায় তুলে নিতে পারেনি যার কারণে সবকিছু ফেলে, কাউকে না জানিয়ে ট্রাম্প ন্যাটো জোট থেকে গোপনে লন্ডন ছেড়েছিল। ইতিহাসের পাতা খুঁজলে এমন ধরনের ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। যাইহোক ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরাজয় হলো, বাইডেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নতুন করে গণতন্ত্রের বাণী বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরলো নতুন করে।
পৃথিবীর রাজনীতি কলুষতায় পরিপূর্ণ। নতুন করে ঢালাই করতে হবে বিশ্ব রাজনীতিকে। ন্যাটোকে জোরদার করতে উঠেপড়ে লেগে গেলো। শুরু হলো যুদ্ধ ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার। মরছে মানুষ, মারছে দানব, দেখছে অমানুষ! প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ বিস্ময়কর বস্তু তৈরি করে আসছে এবং তার পেছনে তাজমহলের মতো স্মরণীয় ঘটনা জড়িত। প্রেমের জগতকে অমর ও স্মরণীয় করতে তৈরি করেন তাজমহল।
ভালো কথা, নারীর প্রতি ভালোবাসা ও স্মরণীয় স্মৃতি তৈরি করা নিঃসন্দেহে এক অপূর্ব ঘটনা। সম্রাটের আরও অনেক রমণী ছিল কি হয়েছিল তাদের বা কিভাবে তাদের প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছিল সে বিষয়ের উপর আমরা কিন্তু আলোচনা করি না। আবার বর্তমানে যে সমস্ত বাংলাদেশি রমণীরা আরব দেশে কর্মরত রয়েছে তাদের প্রতি যে পাষণ্ড অত্যাচার, অবিচার এবং ধর্ষণ চলছে তার ওপরও তেমন কথা বলি না। আমরা ভালোবাসার স্মৃতি গড়তে পছন্দ করি। ভালোবাসার গল্প শুনতে পছন্দ করি।
আমরা রমণীকে ভালবাসতে পছন্দ করি। তাহলে ধর্ষণ কেন? যেসব দেশে ধর্ম নিয়ে বেশি কথা বলা হয় সেখানেই ধর্ষণের পরিমাণ বেশি। জানি না কেন! ধর্মে বলা হয়েছে নর-নারীর প্রতি পারস্পরিক সম্মান, লাভ, আন্ডারস্ট্যান্ডিং, কো-অপারেশন এবং প্যাশন দেখাতে হবে। তা যদি মেনে না চলি বা অন্তরে যদি ভালোবাসা না থাকে তবে ইট পাথরের তাজমহল গড়ে কি হবে?
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রেমের ও ইতিহাসের উদাহরণ হয়ে স্ব-গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে তাজমহল, চমৎকার। সময় এসেছে বিশ্বে নোংরামিতে না জড়িয়ে নিজ নিজ দেশের সমস্যা সমাধানের। পৃথিবীর মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চায়। হোক না সে বাংলাদেশি বা আমেরিকান তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু কীভাবে সম্ভব ভালোবাসার স্মৃতি সৌধ তৈরি করা? হে রহমানির রাহিম তুমি আমাদের মনের গভীরে ভালোবাসার তাজমহল বিরাজ করে দাও, আমরা যেন মানুষ হতে পারি।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। [email protected]