মজনুর রহমান আকাশ, মেহেরপুরঃসরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মেহেরপুরে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে দানাদার বালাইনাশক কার্বোফুরান। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বালাইনাশক অবাধে বিক্রি হলেও সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের তেমন কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। এসিআই কোম্পানীর বিভিন্ন ডিলারদের কাছে এই বালাইনাশক রয়েছে বলে বেশ কয়েকটি সুত্র জানিয়েছেন। অন্যদিকে ওই ডিলারগন দানাদার বালাইনাশক বিক্রি করেন না মর্মে দাবী করেছেন। আর কৃষি অফিস বলছে, প্রত্যেক ডিলারকে এ ব্যাপারে সচেতন করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে গাংনী কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন গাংনীর করমদি গ্রামের আশ্রাফ ট্রেডার্সের একটি ঘর থেকে ১১ প্যাকেট দানাদার বালাইনাশক কার্বোফুরান বিনষ্ট করেন। সোমবার সকালে স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রিংকু এ অভিযান চালায়। আশ্রাফ আলী এ বালাইনাশক এসিআই কোম্পানীর প্রতিনিধির কাছ থেকে নিয়েছেন এবং অনেকেই এ বালাইনাশক বিক্রি করছেন বলেও স্বীকার করেন।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বালাইনাশকের একটি তালিকা করে। তাতে কার্বোফুরান বা কার্বোমেট-জাতীয় বালাইনাশককে মারাত্মক ক্ষতিকর (এক্সট্রিমলি হেজারডাস) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ’৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিল্যান্ড বালাইনাশকটি নিষিদ্ধ করে। তবে দামে কম হওয়ায় ও পোকা দমনে ভালো কাজ করায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর ব্যবহার চলতে থাকে। ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসব দেশ বালাইনাশকটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
২০২৩ সালে জুন মাসে বিশ্বের ৮৮তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কার্বোফুরান নামের বালাইনাশক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর চিহ্নিত করে ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি এটি নিষিদ্ধ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জারি হওয়া ওই গেজেট জুন মাস থেকে এটির আমদানি, ব্যবহার ও উৎপাদন বন্ধ করার আদেশ দেয়া হয়। আদেশে বলা হয়, অবিক্রিত কীটনাশক সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর কাছে ফেরত প্রদান অথবা নিজ দায়িত্বে ধ্বংস করতে হবে।
কৃষিবীদ আব্দুর রউফের মতে, কার্বোফুরান জাতীয় দানাদার বালাইনাশক মানুষের জন্য ক্ষতিকর তো বটেই, গাছের পরাগায়ণের ভূমিকা রাখা বিভিন্ন জাতের মাছি, প্রজাপতি থেকে শুরু করে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রেখে চলা লেডি বিটল ও টাইগার বিটলের মতো পোকা এর কারণে মারা যায়। এটি মাটির উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও কেঁচো এবং মাছের ক্ষতি করে।
একটি সুত্র জানায়, কৃষি অফিসের একটি চক্রকে ম্যানেজ করেই তারা এ ধরনের কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। সুত্রটি আরো জানায়, তরল বালাই নাশকের ৭ দিন থেকে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত কার্যকরী ক্ষমতা থাকে। আর কার্বোফুরান কার্বোমেট দানাদার বালাইনাশকের কার্যকরী ক্ষমতা থাকে ৩০ দিন থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত। ফলে প্রত্যেকেই অজ্ঞাতসারে এ কীটনাশকের ছোবল গ্রহন করছেন।
বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবসায়িরা চাষিদেরকে নানাভাবে এসব দানাদার বালাইনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে করে চাষিরা ভাল ফলাফলের আশায় এসব ব্যবহার করছেন। অনেকেই সন্ধ্যায় বালাইনাশক ব্যবহার করে সকালে সবজিসহ অন্যান্য ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করছেন। শুধু ভোক্তা বা ক্রেতা নয়, উৎপাদন কাজে নিয়জিত কৃষকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন নানা ধরনের রোগে। প্রকাশ্য ও গোপনে এসব দানাদার বালাইনাশক বিক্রি হলেও কৃষি অফিস তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার সুপ্রভা রাণী জানান, এমন কতগুলো বালাইনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ আছে যা শাক সবজিতে স্প্রে করার পর ভালো করে ধুলেও সবজি শতভাগ পরিষ্কার ও নিরাপদ হয় না। ওই সবজি খেলে কিডনি, লিভার, স্তন, ফুসফুস, পাকস্থলী, প্রস্টেট, অগ্নাশয় ও ব্লাড ক্যানসারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতন করতে হবে। অর্গানিক উপায়ে খাবার উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার জানান, কার্বোফুরান মানব দেহ শুধু নয়, পশু পাখি এমন কি গাছ ও মাটির উপকারী কীটেরও ক্ষতি করে। এ জন্য এ বালাই নাশককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কৃষকদেরকে এ বালাইনাশক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার পরও অনেক ক্ষেত্রে কৃষক তা যথাযথভাবে মানেন না। বিভিন্ন বালাইনাশক বিক্রয়কারীকে এটি বিক্রির জন্য নিষেধ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে একজন বিক্রয়কারীর দোকানে অভিযান চালিয়ে কিছু বালাইনাশক কার্বোফুরান বিনষ্ট করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কৃষি অফিসের যোগ সাজশে এ ধরনের বালাইনাশক বিক্রি হচ্ছে মর্মে অভিযোগে ব্যাপারে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হন নি।