
ফুসফুস ক্যান্সার পুরুষ-মহিলা সবার জন্য এক আতঙ্কের নাম, কারণ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার জনের বেশি মারা গেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে ১২ হাজারের বেশি মানুষ ফুসফুস ক্যান্সারে মারা গেছেন। যদিও দেশে ক্যান্সার রেজিস্ট্রি না থাকায় আক্রান্ত ও মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। দেশে শনাক্ত রোগীদের অধিকাংশই অ্যাডভান্সড স্টেজে পৌঁছার পরই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, যখন রোগের জটিলতা বেড়ে যায়। এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে ক্যান্সার ফুসফুস থেকে দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী বেশি কেন?
সুনির্দিষ্টভাবে মূল কারণ চিহ্নিত না হলেও এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তামাক গ্রহণই ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ দায়ী। বিশেষ করে ধূমপান, নিজে করলে তো বটেই এমনকি পরোক্ষ ধূমপায়ীও সমানভাবে এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন।
অ্যাসবেস্টস জাতীয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকলে; বিভিন্ন ধাতব পদার্থের মাত্রা বাতাসে বেশি থাকলে; বাতাসে রেডন গ্যাসের উপস্থিতি থাকলে;
বংশানুক্রমিকভাবেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
লক্ষ্মণগুলো কী হতে পারে
প্রথম দিকে হালকা কাশি, আস্তে আস্তে তা বেড়ে যাবে কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। বুকে ব্যথা করা। শ্বাসকষ্ট হওয়া যা বেড়ে গিয়ে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে। খাওয়ায় অরুচি, শরীর ভেঙে পড়া, ওজন কমে যাওয়া এগুলোও প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
প্রথমে দিকে মাথাব্যথা, খিঁচুনিও দেখা দিতে পারে। অনেক সময় রোগী হাড়ের ব্যথা কিংবা জন্ডিস নিয়ে আসতে পারে এগুলো যথাক্রমে হাড়ে বা লিভারে ছড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ।
ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্তের প্রক্রিয়া
কফ পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ আছে কিনা দেখা যায়। সাধারণ বুকের এক্স-রে থেকে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া সিটি স্ক্যান কিংবা পেট সিটি স্ক্যানের মতো বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে ক্যান্সারের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। প্রয়োজনে বিশেষ পরীক্ষা ব্রঙ্কোস্কোপি করার বিধান আছে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে রোগটি কী ধরনের তা বোঝার জন্য ফুসফুসের আক্রান্ত স্থানে সুই ঢুকিয়ে কোষ সংগ্রহ করা হয়। এরপর প্রাথমিকভাবে তা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা হয়। সূক্ষ্মভাবে কোষ শনাক্তের জন্য সেটির ইমিউনোহিসটোকেমিস্ট্রি করা হয়ে থাকে।
রোগ শনাক্তকরণের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কী?
অন্য সব ক্যান্সারের মতো ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য শনাক্তের পর রোগটি কোন স্তরে আছে তা নির্ণয় করতে হয়। এর ভিত্তিতেই পুরো চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়। মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে, বিশেষ ধরনের কোষ ছাড়া, প্রায় সব ক্ষেত্রে সার্জারি বা অপারেশনের মাধ্যমে রোগ থেকে সমাধান পাওয়া সহজ। অন্যথায় অন্যান্য চিকিৎসার আশ্রয় নিতে হয়। যেভাবে আমরা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় রোগীকে নিয়ে চিন্তা করি তা হলো—সার্জারির মাধ্যমে রোগাক্রান্ত অংশ কেটে ফেলা বা প্রয়োজনে আরো একটু বেশি অংশও ফেলে দেয়া হয়। এছাড়া রোগ ছড়িয়ে পড়লে কিংবা সার্জারি করার পরও কেমোথেরাপি বা বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়। টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপির মতো আধুনিক চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেও করা হচ্ছে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন (আরএফএ) করা যায়। উন্নত বিশ্বে এরই মধ্যে অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রোটন থেরাপি চিকিৎসা চর্চা শুরু হয়েছে। যখন রোগী অত্যন্ত সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যায় তখন জীবনমান ধরে রাখার জন্য মেট্রোনমিক থেরাপি বা প্যালিয়েটিভ ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়।
দেশে ফুসফুসের ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থার সক্ষমতা
রোগীরা প্রাথমিক অবস্থায় এলে সার্জারির মাধ্যমে নিরাময়ের জন্য আমাদের চিকিৎসক আছেন, যারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন ধাপ ও ধরন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতাও আছে। এসব ওষুধের ৯০ শতাংশই দেশে প্রস্তুত হয়। কিন্তু মূল সংকট দেখা দেয় যখন রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয় তখন। অপ্রতুল যন্ত্রের জন্য সময়মতো চিকিৎসা দেয়া যায় না। তাছাড়া প্যালিয়েটিভ সেবার কেন্দ্র প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।
দেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসা দিতে সক্ষম। তবে মূল শত্রু তামাক নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ দূষণের সঠিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন না হওয়ার পাশাপাশি রোগীদের দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসা, অপ্রতুল রোগ শনাক্তকরণ কেন্দ্র ও রেডিওথেরাপি মেশিনের ভয়াবহ স্বল্পতার কারণে ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যুহার বেশি। সার্বিকভাবে এ পরিস্থিতি হতাশাজনকই।
অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ