বাবা ছিলেন চা বাগানের শ্রমিক। নিজেও এখন কাজ করছেন একটি চা বাগানের হিসাব রক্ষক হিসেবে। ফলে একেবারে কাছ থেকে চা শ্রমিকদের জীবনযাপন দেখেছেন তিনি। জানেন তাদের অশিক্ষার কথা, কষ্টের কথা। তাই সমাজের এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান থেকেই কাজ শুরু করেন। পেয়েছেন সফলতাও। তার প্রচেষ্টায় এখন চা শ্রমিকদের অনেকের সন্তান উচ্চশিক্ষিত হয়ে ভালো চাকরি করছেন।
বলছি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি চা বাগানের হিসাব রক্ষক সুনীল বিশ্বাসের কথা। চা শ্রমিক পরিবারে জন্ম নিয়েও নিজের প্রচেষ্টায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। করেছেন শিক্ষকতাও। ভাই-বোন, সন্তানদেরও করেছেন উচ্চশিক্ষিত। শুধু নিজে আর নিজের পরিবার নয়, চা শ্রমিকদের শিক্ষিত আর নেশামুক্ত করতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। গড়ে তুলেছেন থিয়েটার। নাটকের মাধ্যমে তাদের জাগ্রত করতে কাজ করছেন। তুলে ধরছেন তাদের বঞ্চনার কথা।
সুনীল বিশ্বাস জাগো নিউজকে জানান, ১৯৮১ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে এইচএসসি এবং ১৯৮৮ সালে বিয়ে পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ৬ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে চা বাগানে এসে আরও চার বছর শিক্ষকতা করেছেন। পাশাপাশি ঢাকা থেকে নিয়েছেন পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ। ২০০০ সাল থেকে তিনি বাগানের হিসাব রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি বাগান ও এর আশপাশের এলাকার মানুষকে চিকিৎসা সেবাও দেন।
তিনি বলেন, আমি যখন এসএসসি পাস করি তখন বাগান এলাকার কোনো মানুষ পড়ালেখা করতো না। আমার সঙ্গে আমাদের বিদ্যালয় থেকে মাত্র ১০ জন এসএসসি পাস করেছিলাম। নিজে শিক্ষক হওয়ার কারণে আমার ভাই মলিন বিশ্বাস ও বোন চামেলি বিশ্বাসকেও পড়ালেখা করিয়েছি। আমি প্রথম আর আমার ভাই দ্বিতীয় ব্যক্তি যে বাগানে থেকে এসএসসি পাস করেছি। আর মেয়েদের মধ্যে আমার বোন প্রথম যে এসএসসি পাস করেছিল।
সুনীল বিশ্বাস আরও বলেন, আমাদের বাবা হরিদাশ বিশ্বাস ছিলেন বাগানের ফ্যাক্টরির মেশিনম্যান। তিনি এ চাকরির পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। তিনি জীবনে একদিনও মদ পান করেননি। আমি চা শ্রমিকদের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এখান থেকেই মূলত আমরা শিক্ষাগ্রহণ করেছি। বাবা অনেক কষ্ট করে আমাদের পড়ালেখা করিয়েছেন। শিক্ষিত হয়ে আমরা বুঝতে শিখেছি যে মদ পান করা যাবে না। মাদক সেবন কখনোই কল্যাণ এনে দিতে পারে না।

তিনি জানান, তার দুই ছেলে। বড় ছেলে কানন বিশ্বাস প্রকৌশলী। তিনি ঢাকায় একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোট ছেলে প্লাবন বিশ্বাস তবলা বাদকের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট (সিএ) পড়ছেন।
সন্তানদের শিক্ষিত করার পাশাপাশি চা বাগানের প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলনে চান সুনীল। চা শ্রমিকরা মাদক থেকে দূরে থাকবে এটা আর স্বপ্ন। সে জন্য ১৯৮৮ সালে চা শ্রমিকদের কথা তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন প্রতীক থিয়েটার নামে একটি নাট্য সংগঠন। প্রতীক থিয়েটারের মাধ্যমে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে সংগ্রাম করে চলেছেন তিনি। চা শ্রমিকদের জাগ্রত করতে কাজ করছেন। তাদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরছেন।
চা শ্রমিকের সন্তান শাকিল বাউরী। তিনি সরকারি বৃন্দাবন কলেজে বিবিএস প্রথম বর্ষে পড়ছেন। শাকিল বলেন, সুনীল বিশ্বাস আছেন বলেই আমরা আজ চা শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরতে পারছি। তার অনুপ্রেরণায় আজ আমরা পড়ালেখা করছি। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তার প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারছি চা শ্রমিকদের জীবনধারার কথা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী কাঞ্চন বিশ্বাস বলেন, বাগানের শুরু থেকে এখানে শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সুনীল বিশ্বাস যখন এসএসসি পাস করেন তার আগে বাগানে কেউ এসএসসি পাস করেননি। তার অনুপ্রেরণায় এখন এই বাগানের হাজারও ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হয়েছেন। সুনীল এ বাগানের উন্নয়নের কান্ডারি।
শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মিলি ভূমিজ প্রতীক থিয়েটারের একজন কর্মী। তিনি বলেন, সুনীল বিশ্বাস যখন এসএসসি পাস করেন তখন বাগানে কেউ পড়াশোনা করতো না। কোনো ছাত্রছাত্রী ছিল না। সবাই তখন শ্রমিক ছিলেন। বাগানে কাজ করতেন। বর্তমানে তাকে দেখে বাগানের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। শুধু তাই নয়, তার প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারের মাধ্যমে মাদক সম্পর্কে আমরা মানুষকে সচেতন করছি।