নিজস্ব প্রতিবেদক:আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে সারাদেশে শুরু হবে ভোটযুদ্ধ, চলবে একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এবার সব আসনে ভোট হবে কাগজের ব্যালটে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছে গেছে। ভোট নির্বিঘ্ন করতে বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য মাঠে থাকছেন।
আজ সকাল থেকেই পুরো দেশের নজর থাকবে ভোটের দিকে। নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ–পাল্টা অভিযোগ ছাপিয়ে দেশের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা বলছেন। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের প্রার্থী, ভোটার এবং কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে চলছে ভোটের নানা হিসেব–নিকাশ।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, সর্বাধিক সংখ্যক প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। উৎসবমুখর ভোট হবে এটাই আশা। তিনি ভোটারদের নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে এসে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের আহবান জানান।
সিইসি বলেন, যেকোনো মূল্যে এবারের নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে, এজন্য ইসির পক্ষ থেকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে এসে নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন, সেজন্য পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনে এবং ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে অবাধে যাতায়াত করতে পারে সেজন্য মাঠ পর্যায়ে পুলিশ, র্যাব, আনসার-ভিডিপি, আর্মি, নেভি, কোস্টগার্ডসহ সবমিলিয়ে প্রায় ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণের কাজে ৮ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকবে। এছাড়াও ১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী স্ট্যান্ডবাই থাকবে। ৩ হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক মাঠে থাকছে। তারা যেকোন অপরাধে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে ভোট কেন্দ্র, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ভবনের নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়েছে ইসি। এতে বলা হয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সারা দশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনায় মোট ৪২ হাজার ২৪টি ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সম্পাদক বা অনুরূপ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের সঙ্গে সভা করে বা যোগাযোগের মাধ্যমে অথবা দায়িত্ব দিয়ে ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে।
এবার ভোটের সর্বশেষ আপডেট জানার জন্য ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ অ্যাপস চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভোটের সর্বশেষ পরিস্থিতির সঠিক তথ্য সম্পর্কে জনগণ যে কোনো জায়গা থেকে সহজে জানতে পারবে। এছাড়াও ভোটাররা তার ভোটার নম্বর ও কেন্দ্রের নাম এবং অবস্থান জানতে পারবেন। গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে।
এবার ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে দুইজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।
কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এ ছাড়া নির্বাচনে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) প্রার্থী দিয়েছে।
নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপিসহ ১৬টি দল এ নির্বাচন বয়কট করেছে। নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছে দলগুলো।
২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি। সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯। এছাড়া সারাদেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন।
এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে। শুধু দুর্গম অঞ্চলের ২ হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হবে ভোটের আগের দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়ার জন্য গত ৩ জানুয়ারি থেকে সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় নিয়োজিত হয়েছে। উপকূলীয় দুটি জেলাসহ (ভোলা ও বরগুনা) সর্বমোট ১৯টি উপজেলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে।
সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সাথে এবং উপকূলীয় ৪টি উপজেলায় কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্র সমূহে প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান করবে। এই নির্বাচনে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১ জন পুলিশ ও র্যাব সদস্য আইনশৃংখলা রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে।
সারাদেশে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে ৪৮৭টি বেজ ক্যাম্পে ১ হাজার ১৫৫ প্লাটুন বিজিবি নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সারাদেশে নাশকতা এড়াতে বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিজিবি ডগ স্কোয়াড দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। একইসাথে মাঠে কাজ করছে বিজিবি’র বিশেষায়িত ফোর্স র্যাপিড এ্যকশন টিম (র্যাট)। এছাড়া বিজিবি’র কুইক রেসপন্স ফোর্সও প্রস্তুত রয়েছে, যারা বিজিবির অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা রাখে।
নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৮৮ জন সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে। এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় মনিটরিং ও কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন করেছে। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এ মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২ লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৭২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের একটি দল মোতায়েন করা হবে।
নির্বাচন কমিশন জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অস্ত্রধারী দু’জন পুলিশ, অস্ত্রধারী একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠিধারী একজন আনসার, ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দু’জন গ্রামপুলিশ সদস্যসহ ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি দল সব সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। তবে, প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ ৩ জন পুলিশসহ ১৬ থেকে ১৭ জনের দল থাকবে।
এ নির্বাচনে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। আসনপ্রতি ৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবে ইসি। বিশাল এ বাজেটের বেশিরভাগ অর্থই ভোটের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ব্যয় হবে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে প্রাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এবারের নির্বাচনে ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ পুরুষ, ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ নারী এবং ৮৫২ জন হিজড়া।